সিবিএন ডেস্ক:

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়ে কিংবা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর খবর আসছে প্রতি মুহূর্তে। নগরের মসজিদের মাইক থেকে কিছুক্ষণ পরপরই ভেসে আসছে এক একটি বেদনার্ত শোক সংবাদ। চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিল্পপতি, আলেম, কাস্টম কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষার্থী কারো নাম বাদ যাচ্ছে না এ মৃত্যুর মিছিল থেকে।

অসহায় মানুষ ছুটছে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে, কিন্তু চিকিৎসা মিলছে না। এক ফোঁটা অক্সিজেনের জন্য হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছে মুমূর্ষু রোগী। চারিদিকে চিকিৎসার জন্য হাহাকার। আর এভাবেই মৃত্যুর কাছে অসহায় আত্মসমার্পণ করছে মানুষ। যেন স্বয়ং ‘মৃত্যু দেবতা’ নেমে এসেছে নগরবাসীর প্রাণ সংহারে

নগরের বিভিন্ন হাসপাতাল, মৃত ব্যক্তিদের সৎকারকারী প্রতিষ্ঠান ও মাঠ পর্যায় থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত এক সপ্তাহে প্রতিদিন করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়ে কিংবা উপসর্গ নিয়ে ২০ থেকে ২৫ জন মানুষের মৃত্যু হচ্ছে চট্টগ্রামে। পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় এখন আর মৃত ব্যক্তিদের করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে না। তাই করোনাক্রান্ত হয়ে মৃত ব্যক্তিদের সঠিক হিসেবও পাওয়া যাচ্ছে না।

সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (৪ মে) করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. মুহিদুল হাসান ও নগরের পাঁচলাইশ এবং জামালখান এলাকার দুই নারী। তবে এদিন করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন এর চারগুণ বেশি মানুষ।

এদের মধ্যে শ্বাসকষ্টে নগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা গেছেন চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) আসনের সংসদ সদস্য ফজলে করিম চৌধুরীর বড় ভাই ফজলে রাব্বি চৌধুরী, মেট্টোপলিটন হাসপাতাল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এ্যাব) চট্টগ্রামের সভাপতি ও সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ চট্টগ্রামের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার কে এম সুফিয়ান, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে মারা যান চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য ও বন্দর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল আলম এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান মোহরা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক মো. রফিকুল আলম।

এছাড়া বৃহস্পতিবার একদিনে শুধু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে করোনা উপসর্গে আরও সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। দায়িত্বরত চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বেশিরভাগ রোগীরই শ্বাসকষ্টে মৃত্যু হয়েছে।

তারা হলেন- নগরের কোতোয়ালী এলাকার বাসিন্দা সন্তুষ কুমার দত্ত (৬৫), মাদব বিশ্বাস (৭৩), বায়েজিদ বোস্তামি থানা এলাকার রহমত আলী (৩৭), পাচঁলাইশ থানা এলাকার শহর বানু (৮০), রাউজান উপজেলার জ্যোতি শীল (৬৫), ফটিকছড়ির উপজেলার সাইফুল আলম (৪৯) ও মিরসরাই উপজেলার চেমন আরা বেগম (৬০)।

শুধু বৃহস্পতিবারই নয় চলতি মাসের শুরু থেকেই নগরের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। এর বাইরে যারা বাসা-বাড়ি ও উপজেলার গ্রামগুলোতে মারা যাচ্ছেন সেসব তথ্য গণমাধ্যমে আসছেই না। এসব ব্যক্তিদের অধিকাংশের মৃত্যু হচ্ছে করোনা উপসর্গ নিয়েই।

মৃত্যুর হিসেব মেলাতে পারছে না স্বাস্থ্য বিভাগ :

বন্দরনগরী চট্টগ্রামে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় ৩ এপ্রিল। তবে দ্বিতীয় মাসে এসে সে সংখ্যা বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। দুই মাসের ব্যবধানে আক্রান্তের সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়ে গেছে এরইমধ্যে। গত দুই মাসে প্রতিদিন গড়ে কমপক্ষে ৫৪ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে মৃত্যু হয়েছে একজনের। উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর হিসেবে এই হার আরও বাড়বে। কিন্তু আগে মৃত ব্যক্তিদের নমুনা পরীক্ষা হলেও এখন আর তা হচ্ছে না। এ কারণে মিলছে না করোনায় মৃতের প্রকৃত হিসেবও।

চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিভাগের হিসাবে বৃহস্পতিবার (৪ জুন) দুপুরের আগের ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ২ জনের। কিন্তু গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও জাগো নিউজের নিজস্ব অনুসন্ধানে এ মৃত্যু আরও বেশি। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বুধবার (৩ জুন) চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চট্টগ্রাম মেরিন সিটি মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক এবং মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. এহসানুল করিম (৪২), পটিয়া পৌরসভা এলাকার বাসিন্দা গাজী সরওয়ার আলম টুকু ও সীতাকুন্ড উপজেলার একজনসহ করোনা আক্রান্ত চার রোগী মারা যান। এছাড়াও চট্টগ্রামে আক্রান্ত হলেও ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের রাজস্ব কর্মকর্তা জসীম উদ্দিন মজুমদার (৪০) ও ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজের (বারডেম) মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ও চট্টগ্রামের সন্তান ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দীন।

তবে এদিন উপসর্গ ১০ জনের মৃত্যু হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হাসপাতালের ফ্লু কর্নারেই এই ১০ জনের মৃত্যু হয়।

এদের মধ্যে জ্বর ও প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট নিয়ে মৃত্যু হয় মাহবুবুল হক (৬২) ও মারুফ চৌধুরী (৩০) নামে দুই আইনজীবীর। দু’জনেই জ্বর ও শ্বাস কষ্ট নিয়ে ওই হাসপাতালে ভর্তি হন।

এছাড়াও হাসপাতালের করোনা ইউনিটের ইয়োলো জোনে আরও আটজনের মৃত্যু হয়। যাদের মধ্যে নগরীর দুই নম্বর গেট এলাকার ৮৩ বছর বয়সী বেলায়েতুন নেসা নামে এক বৃদ্ধা রয়েছেন। বাকিরা হলেন- বাকলিয়া থানাধীন বউ বাজার এলাকার বাসিন্দা আরাফাত হোসেন (২১), পাহাড়তলী থানাধীন চৌধুরীপাড়ার আবুল হোসেন (৭৫), রাহাত্তারপুল এলাকার মারুফ চৌধুরী (৩৩), চন্দনাইশের দোহাজারীর বদিউল আলম (৪৫), নগরীর বাকলিয়া এলাকার সুপ্রিয় দত্ত (৬০), চান্দগাঁও বাদামতলার আলতাফ হোসেন চৌধুরী (৩৪) এবং মিরসরাইয়ের বৃদ্ধা কানন বালা দেবি (৭৫)।

এর বাইরে বুধবার (৩ জুন) করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) উপসর্গ নিয়ে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে করোনা উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) নগর পরিকল্পনাবিদ সারোয়ার উদ্দিন আহমেদ ও নগরের বেটারি গলি এলাকার বাসিন্দা দিলিপ দত্তসহ (৫০) চারজন। সব মিলিয়ে বুধবার চট্টগ্রামে করোনা ও উপসর্গ নিয়ে ১৬ জনের মৃত্যু হয়।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ বুলেটিনে জানানো হয় এদিন চট্টগ্রাম বিভাগে করোনায় মৃত্যু হয় ১৩ জনের। আল মানহিল ওয়েল ফেয়ার ফাউন্ডেশন জানায় এদিন তারা শুধু চট্টগ্রামেই ১১ জন করোনা রোগী ও একজন করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া মোট ১২ জনের মরদেহ দাফন করেছেন।

ভয়ংকর সোমবার :

জুন মাসে করোনা তার ভয়ংকর রূপ দেখাবে এটা আগে থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল। কিন্তু চট্টগ্রামবাসীর জন্য সোমবার (১ জুন) এতটা ভয়াল হবে তা হয়তো কেউই আঁচ করতে পারেনি। এদিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান ১৯ জন এবং জেনারেল হাসপাতাল ও ফৌজদারহাট বিআইটিআইডিতে মারা যান আরও চারজন।

এদিন চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতাকর্মী এবং আরেকজন পুলিশ সদস্যের মৃত্যু হয়। এদের মধ্যে ২৯ বছর বয়সী ওই কনস্টেবল চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট (পিওএম) বিভাগে কর্মরত ছিলেন। বৃহস্পতিবার (৪ জুন) নমুনা পরীক্ষার রিপোর্টে তার করোনা পজিটিভ আসে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ বুলেটিন নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন রয়েছে। তবে এদিন তাদের হিসেবেও সারাদেশে চট্টগ্রাম বিভাগে সর্বোচ্চ ১৫ জনের মৃত্যু হয় বলে জানানো হয়। স্বাস্থ্য বুলেটিনে বলা হয়, সোমবার ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যুবরণকারী ৩৭ করোনা রোগীর মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যক ১৫ জনই চট্টগ্রাম বিভাগের।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা সেদিন বলেন, দেশের আটটি বিভাগের মধ্যে রাজধানী ঢাকা তথা ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চসংখ্যক আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত ও মৃত্যুঝুঁকির তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের নাম।

অফিস ফাইলের হিসেব মেলে না কবরস্থানে ও শ্মশানে :

চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন অফিসের হিসেব অনুযায়ী এ পর্যন্ত চট্টগ্রামে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৮৭ জন। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি শুরুর পর থেকে চট্টগ্রামে যে কয়টি প্রতিষ্ঠান করোনা আক্রান্ত ও উপসর্গে মৃতদের দাফন-সৎকার করেছেন তাদের হিসেবে এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি।

আল মানহিল ওয়েল ফেয়ার ফাউন্ডেশন জানিয়েছে চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত তারা ১২০ জনের লাশ দাফন করেছে। যাদের অধিকাংশই করোনা রোগী। এরমধ্যে বুধবার তারা চট্টগ্রামে ১১ জন করোনা রোগী ও একজন করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া মোট ১২ জনের মরদেহ দাফন করেছেন।

এদিকে চট্টগ্রামে করোনায় মারা যাওয়া সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মরদেহ সৎকার করছে সেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ‘করোনা মৃতদেহ সৎকার সংঘ’।

সংগঠনটির আহ্বায়ক সুমন পাল জাগো নিউজকে জানান, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তারা ২৫ জন করোনা রোগী ও করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন এমন মরদেহ সৎকার করেছেন।

কোয়ান্টম ফাউন্ডেশন চট্টগ্রামের সদস্য দেবাশিষ পালিত দেবু জাগো নিউজকে জানান, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তারা চট্টগ্রামে ৪৫ জনের মরদেহ দাফন ও সৎকার করেছেন। যারা করোনায় আক্রান্ত হয়ে অথবা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন।

এছাড়া চট্টগ্রামে করোনায় বা উপসর্গ নিয়ে মৃত নারীদের দাফনে কাজ করছে ‘মুর্দা সেফা’ নামে একটি সংগঠন। সংগঠনের প্রকল্প পরিচালক ও উদ্যোক্তা আলোকচিত্রী মো. শাহজাহান জানান, গত দেড় মাসে তার সংগঠন চট্টগ্রামে অর্ধশতাধীক নারীর দাফন কাজ সম্পন্ন করেছেন। এদের সবাই করোনাভাইরাসে বা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন।

সব মিলিয়ে গত দেড়মাসে চট্টগ্রামে করোনা আক্রান্ত ও উপসর্গে মৃত অন্তত ২৪০ জনের দাফন ও সৎকার করেছে প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব প্রতিষ্ঠানের বাইরেও চট্টগ্রামে গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান করোনা আক্রান্ত ও উপসর্গে মৃতদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে দাফন ও সৎকারের কাজ করছেন।

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও চট্টগ্রামে সংগঠনটির করোনা সেলের প্রধান ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান বলেন, ‘যারা হাসপাতালে মারা যাচ্ছেন তাদের হিসেব হাসপাতালগুলো রাখছে। এদের মধ্যে করোনায় আক্রান্ত ও করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃতু দুই ধরনের রোগী রয়েছে। কিন্তু অনেকে রোগী গোপন করছেন, তারা বাসাতেই মারা যাচ্ছেন। তাই সে হিসেব আমাদের কাছে নেই। করোনায় চট্টগ্রামে মৃত্যুর যে পরিসংখ্যান দেয়া হচ্ছে প্রকৃত অর্থে এর ৩ থেকে ৪ গুণ বেশি রোগী মারা যাচ্ছে। নমুনা পরীক্ষা সহজে না হওয়ার কারণে মৃত্যু ও আক্রান্তের প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।’

করোনা প্রাণ নিলো তিন চিকিৎসকের, আক্রান্ত ৭৫ :

চট্টগ্রামে একদিনের ব্যবধানে দুই চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন- চট্টগ্রামে ইউএসটিসি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক সহযোগী অধ্যাপক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এহসানুল করিম ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার ডা. মুহিদুল হাসান।

এছাড়া চট্টগ্রাম নগরী ও জেলায় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরতদের মধ্যে ৭১ জন চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ১৭ জন। করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন একজন।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক ডা. ফয়সাল ইকবাল চৌধুরী বলেন, ’৭১ জন আক্রান্তের মধ্যে ১৭ জন ডাক্তার এরই মধ্যে সুস্থ হয়ে কাজে যোগ দিয়েছেন। বাকিদের মধ্যে তিন জন আশঙ্কাজনক অবস্থায় আছেন। অন্যরা মোটামুটি সুস্থ আছেন। তিনজন ডাক্তার মারা গেছেন। এরমধ্যে একজনের করোনা পরীক্ষার ফল নেগেটিভ আসে। আমাদের ধারণা তিনি করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। কারণ টেস্টে শতভাগ নির্ভুল ফলাফল আসে না। ৩০ শতাংশের মতো ত্রুটি থাকতে পারে।’

চট্টগ্রাম বন্দর-কাস্টমসে মৃত্যু ৫, আক্রান্ত ৫৬ :

বর্তমান সময়ে করোনা সংক্রমণের সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমস। করোনা আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরের এক কর্মকর্তা, এক কাস্টমস কর্মকর্তা ও তিন কর্মচারী মারা গেছেন। আক্রান্ত হয়েছেন কাস্টম হাউজ ও চট্টগ্রাম বন্দরের ৫৬ কর্মকর্তা ও কর্মচারী।

জানা গেছে, করোনা উপসর্গ নিয়ে হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন আরও অন্তত ২৪৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কমিশনার ফকরুল আলম বলেন, সাধারণ ছুটির মধ্যেও সব ধরনের আমদানি-রফতানি পণ্য খালাসে ২৪ ঘণ্টাই সচল ছিল চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ। প্রতিদিন প্রচুর সেবাগ্রহীতা সেবা নিতে আসার কারণে সবসময় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না।

তিনি বলেন, ভিড় কমাতে কর্মকর্তাদের দুই শিফটে কাজ করানো হয়েছে। করোনা উপসর্গ দেখার সঙ্গে সঙ্গে সন্দেহজনক কর্মী ও সংশ্লিষ্ট গ্রুপ ও শিফটে দায়িত্বরতদের ছুটি ও হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে।

চট্টগ্রাম কাস্টমসে এ পর্যন্ত ১৭ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন বলে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের এক কর্মকর্তা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বলেন, বন্দরে এ পর্যন্ত ৪১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনায় আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন। এর মধ্যে চার জনের করোনায় মৃত্যু হয়েছে। একজন উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। ২৪৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে।

পাঁচ পুলিশ সদস্যের মৃত্যু, আক্রান্ত ৩৪৮ :

চট্টগ্রামে করোনা সংক্রমণের একদম শুরুতেই চট্টগ্রাম মেট্রোপলিন পুলিশের একটি ব্যারাকে রোগটি ছড়িয়ে পড়ে। একারণে শুরু থেকেই তারা ঝুঁকিতে ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের দেয়া তথ্যানুযায়ী, চট্টগ্রামে পুলিশ ও র‌্যাব সদস্য মিলিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৪৮ জন। এর মধ্যে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশে (সিএমপি) সর্বোচ্চ আক্রান্ত হয়েছেন ১৬৬ জন। সুস্থ হয়েছেন ৫৬ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ৩ জনের। আরও ২ জন করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন।

চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের আক্রান্ত হয়েছেন ৮৭ জন সদস্য। সুস্থ হয়েছেন তিন জন এবং একজন মারা গেছেন। শিল্প পুলিশের ৪৬ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ৮ জন সুস্থ হয়েছেন। র‌্যাব সদস্যদের মধ্যে ৪৯ জন আক্রান্ত ও চারজন সুস্থ হয়েছেন। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের চার জন কারারক্ষীও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।

চিকিৎসা নৈরাজ্যে চট্টগ্রামে এত মৃত্যু :

সম্প্রতি চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী, শিল্পপতিসহ একাধিক ব্যক্তির বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেখানে প্রতিষ্ঠিত লোকজনই চিকিৎসা নৈরাজ্যের শিকার হচ্ছেন সেখানে সাধারণ মানুষের বেলায় যে কী ঘটছে তা খুব সহজে অনুমেয়। তাই বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়ানো, চিকিৎসা না পাওয়াসহ নানা কারণে করোনার উপসর্গ থাকলেও তা গোপন করা হচ্ছে। মৃত্যুর পর দ্রুততম সময়ে মরদেহ দাফন করা হচ্ছে। অনেকে পরীক্ষা করালেও আবার হয়রানি এড়াতে রিপোর্ট নিচ্ছেন না। চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ৮৫ জন রোগীর কোনো খোঁজ মিলছে না।

চিকিৎসা নৈরাজ্যের শিকারদের মধ্যে আছেন চট্টগ্রাম বিভাগের স্বাস্থ্য পরিচালক হাসান শাহরিয়ারও। কিডনি ডায়ালাইসিসের জন্য তার মাকে চট্টগ্রামের কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করতে চাইলেও পারেননি তিনি।

নিরুপায় হয়ে পরে তিনি চলে যান ঢাকায়। চট্টগ্রাম বারের বিশিষ্ট আইনজীবী আবুল কাশেম চৌধুরী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা শিক্ষা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক অধ্যাপক সাবরিনা ইসলাম সুইটি, চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যানের পিএস, শিল্পপতি মোহাম্মদ ইউনুচ, মাদারবাড়ি ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাজহারুল ইসলামসহ অসংখ্য মানুষ চট্টগ্রামে চিকিৎসা নৈরাজ্যের শিকার হয়ে মারা গেছেন। তবে করোনা উপসর্গ থাকলেও করোনা পজিটিভ ছিল কিনা তা শেষ পর্যন্ত জানা যায়নি। মারা যাওয়ার পর এদের নমুনাও নেয়া হয়নি। ফলে জানা গেল না তারা কোভিড-১৯ রোগী ছিলেন কিনা।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবির জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার গ্রিন জোনে (করোনা উপসর্গ) প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১২ জন রোগী মারা যাচ্ছেন। এই হারটা অনেক বেশি। তবে তুলনামূলকভাবে রেড জোনে (করোনা পজিটিভ) মৃত্যুর হার কম। রেড জোনের তুলনায় গ্রিন জোনে মৃত্যু বেশি হচ্ছে। এর কারণ গ্রিন জোনের রোগীরা শ্বাসকষ্ট, ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা, কিডনির সমস্যাসহ নানাবিধ সমস্যায় ভুগছেন। কিন্তু এখানে ধারণ ক্ষমতার বেশি রোগী হওয়ায় তারা সঠিক ট্রিটমেন্ট পাচ্ছেন না। এক জায়গায় বিভিন্ন রোগের ট্রিটমেন্ট করা যাচ্ছে না। এর সঙ্গে রয়েছে অক্সিজেনের স্বল্পতা।’

রোগী মৃত্যুর এই হার জেনারেল হাসপাতালেও বেশি। প্রতিদিন করোনা উপসর্গ নিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মোহাম্মদ আবদুর রব বলেন, ‘করোনা মহামারিতে ৫ শতাংশ রোগী থাকে মুমূর্ষু। এই মুমূর্ষু রোগীদের জন্য প্রয়োজন হাইফ্লো অক্সিজেন। কিন্তু সিলিন্ডারে সেই চাপ থাকে না।’

এ অবস্থায় করোনা আক্রান্ত ও উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসায় হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলার সংকট সমাধানে কার্যকরী ভূমিকা রাখা না গেলে আরও প্রাণহানি হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ভারপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মোস্তফা খালেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আসলে আক্রান্তের হার বেড়ে গেছে, তাই চট্টগ্রামে মৃত্যুর পরিমাণও বেড়ে গেছে। অনেকেই করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন। তাদের সবার তথ্য হয়তো আমাদের কাছে নেই।’

বর্তমান করোনা আক্রান্ত হয়ে আইশোলেসনে আছেন বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক হাসান শাহরিয়ার কবির। তিনি বলেন, ‘রোগী শনাক্ত ও চিকিৎসার পরিমাণ বাড়ানো না গেলে মৃত্যুর এই হার আরও বাড়বে।’